ইউরোপীয় রাজপ্রাসাদ ⚠️

#আপনি_কি_জানেন
✅বাংলার মাটিতে বিলেতের ছোঁয়া—এ যেন উপনিবেশিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে উত্তর ২৪ পরগণার ধান্যকুড়িয়ায়। আজ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী তিরিশ বছর আগে, এই রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন ধান্যকুড়িয়ার প্রভাবশালী জমিদার মহেন্দ্রনাথ গায়েন। পাটের ব্যবসার সুবাদে তিনি একদিকে যেমন অপার সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ছিল ইউরোপের বাজার পর্যন্ত, আর সেই নেটওয়ার্কেরই এক প্রতিফলন ছিল তাঁর তৈরি এই রাজপ্রাসাদ—যা একাধারে এক নিখুঁত ইউরোপীয় দুর্গ, আবার অপরদিকে বাংলার ঐতিহ্যের এক অনন্য সাক্ষী।
এই রাজবাড়ি নির্মাণে যে ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়েছিল, তা শুধু স্থাপত্যের বাহ্যিক গঠনেই নয়, ছড়িয়ে আছে প্রতিটি অলিন্দ, প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি কার্নিশে। প্রায় ৩০ একর জমির উপর গড়ে ওঠা এই প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি বিস্তৃত পুষ্করিণী, যেখানে দিনের আলোয় ঝলমল করে ওঠে পুরো রাজবাড়ির প্রতিচ্ছবি। এই পুকুর এবং আশেপাশের বাগানজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন আমগাছ, কাঠালগাছ, রক্তচন্দনসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ—যা একসময় রাজবাড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলত।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ভিক্টোরিয়ান যুগের অলঙ্করণ, দেয়ালের অলংকৃত গম্বুজ, সুদৃশ্য নকশাকৃত বারান্দা, এবং ইতালির কাচ ও কাঠের মেলবন্ধনে তৈরি আসবাবপত্র। যেন ইউরোপের কোনও অ্যারিস্টোক্র্যাটিক ভিলা হঠাৎ করেই স্থান পেয়েছে বাংলার এক গ্রামীণ প্রান্তরে। ব্রিটিশ সাহেবদের যাতায়াতের সুবিধার্থে তৈরি হয়েছিল পৃথক অতিথিশালা, নহবতখানা, এবং এমনকি একটি নিজস্ব রেল স্টেশনও—“গায়েন গার্ডেন” নামে পরিচিত সেই স্টেশনটি একসময় মার্টিন কোম্পানির ন্যারো গেজ ট্রেনের গন্তব্য ছিল। যদিও বর্তমানে সেই স্টেশনের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০০৮ সালে এটি সরকার অধিগ্রহণ করে একটি অনাথ মেয়েদের হোম হিসেবে গড়ে তোলে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রাজবাড়ি আজ তার অতীত ঐশ্বর্যের বহুটা হারিয়ে ফেলেছে। বাড়ির প্রবেশদ্বারে স্থাপিত দুটি শ্বেতপাথরের সিংহমূর্তির মধ্যে একটি বহু আগেই চুরি হয়ে যায়, আর অপরটি উত্তরসূরিরা অর্থকষ্টে বিক্রি করে দেন। রাজবাড়ির প্রধান অংশগুলোর কিছুটা সংস্কার করা হলেও, মোটের উপর এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত ও জীর্ণ দশায় দাঁড়িয়ে সময়ের সাক্ষী হয়ে।
তবু, এই রাজবাড়ির ইতিহাসে শুধু জমিদারি কিংবা ব্রিটিশ সম্পর্কই নয়, রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রেরও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এখানে শুটিং হয়েছে ‘সত্যান্বেষী’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘সূর্যতপা’-র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের। অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা। এমনকি বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এই দুর্গনির্মিত প্রাসাদে শুটিং করেছেন, যা বাংলার মাটিতে এর আন্তর্জাতিক গুরুত্বও প্রতিষ্ঠা করেছে।
আজও, ধান্যকুড়িয়ার এই রাজবাড়ি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক কাঠামো নয়, বরং একটি যুগের কথা বলে—যেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ, বাংলার জমিদারতন্ত্র, ইউরোপীয় শিল্পকলার মেলবন্ধন এবং বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একত্রে জড়িয়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণ আর সংরক্ষণের অভাবে যদিও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে তার গৌরব, তবু যাঁরা ইতিহাস ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে এই রাজবাড়ি এক অনন্য ধ্যানস্থল—যেখানে বিলেত এসে মিশেছে বাংলার হৃদয়ে।