বাইতুল হিকমাহর সাথে জড়িয়ে আছে বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর কাহিনী।

আব্বাসীয় খেলাফতের সময় (The Abbasids) বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক উৎকর্ষের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল বাগদাদ।
বিজ্ঞানচর্চায় তাদের অর্থায়নের অন্যতম উদাহরণ বাগদাদের বিখ্যাত লাইব্রেরি, বাইতুল হিকমাহ।
ইংরেজিতে যাকে বলা হয় হাউজ অব উইজডম।
পঞ্চম শতকের আশপাশ থেকে অন্তত নবম শতক পর্যন্ত এই লাইব্রেরির সংগ্রহ ছিল বিশ্বে সবচেয়ে বড়।
এর অঙ্গন সর্বদা মুখরিত থাকত তৎকালীন বড় বড় পন্ডিতদের ভিড়ে।
বাইতুল হিকমাহর সাথে জড়িয়ে আছে বহু দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর কাহিনী।
এদের অন্যতম মুসা আল-খাওয়ারিজমি (Muḥammad ibn Mūsā al-Khwārizmī )।
একাধারে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী এই ব্যক্তি বীজগণিতের জনক বলে অভিহিত।
জাতে পারসিক আল-খাওয়ারিজমি ভূগোল, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে রচনা করেছেন অনেক মূল্যবান পুস্তক।
৮২০ সালে তাকে লাইব্রেরির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
বাইতুল হিকমাহর নিয়মিত দর্শনার্থীদের মধ্যে আরো ছিলেন বনু মুসা ভ্রাতৃত্রয়- মুহাম্মদ, আহমাদ এবং হাসান।
গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় ছিল তাদের পদচারণা।
যন্ত্র-প্রকৌশল বা মেকানিক্সের বিকাশে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাইতুল হিকমাহর অন্যতম একটি কাজ ছিল বিজ্ঞানের বই গ্রীক, সংস্কৃত, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করা।
বলা হয়, এই কাজকে প্রণোদনা দিতে চমকপ্রদ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন খলিফা আল-মামুন- অনূদিত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হবে অনুবাদককে।
গ্রীক পন্ডিতদের অনেক লেখা আরবিতে তর্জমা করা হয়েছিল। পিথাগোরাস, প্লাটো, অ্যারিস্টোটল, হিপোক্র্যাটস, গ্যালেন, সক্রেটিস, ইউক্লিড কেউ বাদ যাননি।
আল-কিন্দি (Al-Kindi) জড়িত ছিলেন অ্যারিস্টোটলের অনুবাদকর্মে, হুনায়ন ইবন ইশহাক (Hunyan ibn Ishaq) করেছিলেন হিপোক্র্যাটসের ভাষান্তর।
আরো অনেক প্রসিদ্ধ অনুবাদকের লেখা জমা ছিল বাইতুল হিকমাহতে।
উল্লেখযোগ্য হলেন আল-বাতরিক (Yahya Ibn al-Batriq), হাজ্জাজ ইবন মাতের (Hajjaj Ibn Mater), আল-বুলবাকি (Qosta Ibn Luqa al Bulabakki), ছাবিত ইবন-কুরাহ (Thabit Ibn Qurah) এবং আরো অনেকে।
সংস্কৃত থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ ভাষান্তরে বাইতুল হিকমাহর অবদান অনেক।
এর ফলেই আরব গণিতবিদেরা শূন্যের ধারণা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান।
সংখ্যা বোঝাতে ভারতে আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করা হতো। এর উন্নয়ন ঘটিয়ে বর্তমান আরবি সংখ্যাপদ্ধতির প্রচলন হয়।
এই বাইতুল হিকমাহতে বসেই আল জাহিজ নানারকম প্রাণীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘The Book of Animals’।
আল-মালিক নির্ণয় করেছিলেন এমন পরিমাপ যা ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিধি নির্ধারণ করেছিলেন ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদরা।
বলা হয়, গ্রন্থাগারে পা রাখলে আরবি, ফারসি, হিব্রু, গ্রীক, ল্যাটিন হেন কোনো ভাষা নেই যা শোনা যেত না।
লিঙ্গ, ধর্মবিশ্বাস, গায়ের রঙ, জাতপাত, ভাষা যা-ই হোক, কারো জন্যই বন্ধ ছিল না লাইব্রেরির দরজা।
হুনায়ন ইবন ইশহাকের কথাই ধরা যাক। পেশায় চিকিৎসক হুনায়ন ছিলেন খ্রিষ্টান, কিন্তু সেজন্য লাইব্রেরির দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি তার সামনে।
বরং মেধাকে আরো বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
জ্ঞানের নানা শাখায় অবদান রেখেছেন হুনায়ন। পৃথিবীর ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা এসব নিয়েও কাজ আছে তার।
গ্রীক ওল্ড টেস্টামেন্ট (Septuagint) আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি, দুঃখজনকভাবে সেটা হারিয়ে যায়।
আল-মামুনের মৃত্যুর পর থেকেই মূলত ধীরে ধীরে বাইতুল হিকমাহর অবক্ষয় শুরু হয়।
পরবর্তী খলিফা আল-মুতাসিমের সময় আব্বাসীয়রা দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে সামারায় (Sāmarrā) প্রশাসনিক অনেক কিছু সরিয়ে নেয়।
এরপর থেকে সম্ভবত পরবর্তী খলিফারা লাইব্রেরি টিকিয়ে রাখলেও এর উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেননি।
তবে জ্ঞানপিপাসুদের কাছে এর আবেদন কমেনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলতে থাকে অনুবাদকর্ম।
বাইতুল হিকমাহ চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ত্রয়োদশ শতকে।
১২৫৮ সালে ঝড়ের মতো ইরাকে ঢুকে পড়ে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী, বাগদাদ তছনছ করে দেয় তারা।
নির্বিচার নরহত্যায় লাল হয়ে যায় টাইগ্রিসের পানি।
এককালের জৌলুষময় বাগদাদকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় মোঙ্গলরা।
এর সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাইতুল হিকমাহ।
জ্যোতির্বিদ আল-তুসি (Nasir al-Din al-Tusi) অবশ্য কিছু বই রক্ষা করতে সক্ষম হন।
পরিস্থিতি বুঝে আগেই সেগুলো তিনি সরিয়ে ফেলেছিলেন ইরানের মারাঘেহ মানমন্দিরের লাইব্রেরিতে।
বাইতুল হিকমাহর প্রকৃত প্রভাব নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে।
অনেকেই মনে করেন, যেসব অনুবাদের সাথে এর নাম জড়ানো হয়, তার অনেকগুলোর পেছনে বাইতুল হিকমাহ’র কোনো ভূমিকা ছিল না।
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর প্রভাবে লাইব্রেরি গড়ে তোলার চর্চা শুরু হয় চারদিকে।
অনেক ধনবান ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করেন স্থানীয় পাঠাগার।
অন্যান্য রাষ্ট্রও বাগদাদের আদলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা আরম্ভ করে।
ইসলামিক বিশ্বের নামজাদা বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করতে তৈরি করা হয় বিশাল বিশাল লাইব্রেরি।
কর্ডোবাতে দশম শতকে দ্বিতীয় আল-হাকাম তেমনই একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেন।
এই পথ ধরে দ্বাদশ শতকে আন্দালুসিয়ার টলেডো পরিণত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম পীঠস্থানে।
সব ধর্ম-বর্ণের পন্ডিতেরা ভিড় জমান এখানে।
আরবি থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হতে থাকে নানা গ্রন্থ।
১০০৫ সালে কায়রোতে ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম প্রতিষ্ঠা করেন দারুল হিকমাহ (Dar al-Hikma)।
প্রায় ১৬৫ বছর বাইতুল হিকমাহর পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে এর নাম।
অন্যান্য মুসলিম দেশেও একইভাবে জ্ঞানের ঘর বা দারুল ইলম (Dar al-‘Ilm) তৈরি করেন শাসকরা।