ওরা গেলো কোথায়?

0
251

 

এমনকি পাঁচ-ছয় দশক আগেও দেশজুড়েই ছিলো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিস্তৃতি। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঘাবাড়ি, বাঘা, বাঘবেড়, বাঘাদিয়া, বাঘের টেক, বাঘঘোনা, বাঘপাড়া, টাইগার হিল, টাইগার পাস ইত্যাদি নানা নামের এলাকাই তার স্বাক্ষী৷ বহু উপকথা ও সাহিত্যকর্মে সারা বাংলা জুড়েই বাঘের আনাগোনা দেখা গেছে অনাদিকাল থেকে তাই বাগধারাতেও উঠে এসেছে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই নাকি সন্ধ্যা হয়! এইতো সেদিন, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত লোকালয় বা বনে বাঘেরা আবির্ভাব বিবেচিত হতো জনদূর্ভোগ হিসেবে। তাই বাঘ মারলে মিলতো সরকারী আর্থিক প্রণোদনা৷ বন বিভাগে চাকুরীই ছিলো শিকারী পদবিতে৷ বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজীর মত অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে বা বন বিভাগের হয়ে শখানেক বাঘ মেরেছেন মূলত শিকারের নেশা আর আর্থিক প্রনোদনার কারণেই। আর রাজা-বাদশা-নবাব থেকে অধুনালিপ্ত জমিদারদের জন্য বাঘ শিকার ছিলো ক্ষমতা আর আভিজাত্যের চূড়ান্ত প্রকাশ। সেজন্য মাত্র একশো বছর আগেও ভাওয়াল রাজাকেও দেখা যায় গাজীপুরের বনে বাঘ মেরে শিকারের উপর দাঁড়িয়ে পোজ দিতে৷ 

 

দেশজুড়ে জড়িয়ে থাকা সেইসব বাঘ মেরে, জঙ্গল কেটে কবেই শহর বানিয়ে ফেলেছি আমরা। এখন প্রচলিত মতানুসারে তারা শুধু সুন্দরবনেই টিকে আছে। ক্যামেরা ট্র‍্যাপ পদ্ধতিতে করা সাম্প্রতিক বাঘশুমারী বলছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫ টি। কিন্তু সুন্দরবনের অতি পরিশ্রমী বাঘের বাইরেও সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা এত এত বাঘ কি একদমই বিলুপ্ত হয়ে গেলো? তা কিভাবে সম্ভব? আমাদের আছে বিস্তৃত পার্বত্যাঞ্চল, সিলেটের সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ী জঙ্গল। কোন না কোন বনে এক-আধটা বাঘ তো থেকে যেতেই পারে! তাইনা? এগুলো বাস্তব না জানি। কারণ এখন আর এসব অঞ্চলে বাঘ সার্ভাইভ করার মত শিকার নেই। তবু এই কল্পনাবিলাসেও আছে বিশাল আনন্দ কারণ বাঘ থাকলে আমাদের পার্বত্য বনও মানুষের হাত থেকে থাকতো সুরক্ষিত!!

 

কয়েক বছর আগে দার্জিলিং পাড়ার কারবারীর কাছে বাঘ দেখার স্বাক্ষীর সন্ধান পেয়ে তার খোঁজে নিকটবর্তী ম্রো পাড়ায় গেলাম। তিনি অনুপস্থিত ছিলেন বাট গল্পটা দেখলাম সবাই জানে৷ কাছাকাছি ঘটনা শুনলাম লামাফেরত একজনের মুখে। রুমার গহীনে মদের নেশায় চূর এক দাদা শুনিয়েছিলেন ছোটবেলায় তার বাঘের বাচ্চা পোষ মানানোর গল্প। তবে এর সবই অনির্ভর‍যোগ্য সূত্র! 

 

এই বিষয়ে তিন বছর আগে ইংল্যান্ডের দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রামে CCA'র খুঁজে পাওয়া বাঘের পায়ের ছাপের ছবিই এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রামাণ্য এভিডেন্স। এই নিউজটি প্রথম আলোসহ দেশের অনেক মিডিয়া ফলোআপ করলেও সুন্দরবনের বাইরে বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে দেশবাসী রয়ে গেছে সেই তিমিরেই! 

 

অথচ ২০০৮ সালে সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ে বাঘ দেখার দাবীদার পাওয়া গেছে। লাঠিটিলার জঙ্গলে বাঘ দেখেছেন এমন দাবীদারও মিলেছে। যারা দেখেছেন তারা শিকারী মানুষ। হরিণ-শুকর মারতে বনে যায়। তারা চিতা আর বাঘের প্রভেদ করতে জানে। কিন্তু কোন বনেই বাঘের পর্যাপ্ত শিকার না থাকা এসবকে ভুল ভাবতেই যুক্তি দেখায়৷ 

 

সাজেক ভ্যালি নাম হলেও এটি কিন্তু আদতে ভ্যালি নয়, পাহাড়। সাজেকের পুবে মিজোরামের বিস্তৃত জঙ্গল। গুগল আর্থে খুঁজলে দেখা যায় ডামপা টাইগার রিজার্ভ নামের এক অভয়ারণ্য। সুখের সংবাদ কিছুদিন আগে বহুবছর পর ডামপায় বাঘের দেখা মিলেছে। এর উত্তর-পশ্চিমে আমাদের দেশের কাসালং রিজার্ভ ফরেষ্ট। গুগল আর্থে দেখলে দেখবেন কি ভয়াবহ ঘন বুনটের বন। সেই বনে অন্তত ৮টি বাঘ আছে বলে এক গবেষকের অনুমান। আর স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী তো আছেই। সর্বশেষ ২০১০ সালেও সুনির্দিষ্টভাবে বাঘ দেখার দাবী পাওয়া গেছে কাসালং রিজার্ভে। 

 

আমার দুই প্যারা আগে বর্ণিত ঘটনার বাইরেও ২০০৪ ও ২০১১ সালে বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভে বাঘ দেখার প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন সেখানে অন্তত তিনটি বাঘের আনাগোনা থাকতে পারে। আর যেহেতু বাঘের বিচরণস্থল শত শত বর্গকিলো হতে পারে তাই বাঘগুলো সীমান্তের এপার ওপার করতেই পারে। অসম্ভব কিছুনা। কিন্তু আবারও এন্টি লজিকে চলে আসে শিকারের অভাব!

 

সর্বশেষ বাঘ দেখার খবর শুনলাম বান্দরবান-রাঙামাটির রাইক্ষ্যং ভ্যালিতে। বাঘ গবেষক ড. মনিরুল এইচ খানকে চার-পাঁচ বছর আগে আজকের দিনে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জানিয়েছেন, রাইক্ষ্যং ভ্যালিতে সীমান্তের এক আদিবাসী শিকারী বাঘ শিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। বাঘের চর্বি -চামড়া মিয়ানমারে বিক্রি হয়েছে বিশ হাজার টাকায়। সে টাকায় সেই আদিবাসী শিকারী তার পরিবারের জন্য সোলার কিনেছেন। 

 

সবকিছু মিলিয়ে আমরা আশা করতেই পারি যে সুন্দরবনের ১১৪ টি ছাড়াও আরো অন্তত কিছু বাঘ টিকে আছে আমাদের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সন্নিহিত প্রতিবেশী দেশের বনে। তবে আমরা গত ৩০-৪০ বছরে যেভাবে আমাদের পার্বত্যাঞ্চল ধ্বংস করেছি তাতে পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে উচ্চস্তরের খাদক এখানে খাদ্যসংকটে ভুগবে। তাই হয়তো বাঘের এখানে স্থায়ীভাবে আবাস গড়ার সুযোগ নেই। তবে অপরিকল্পিত জুমচাষ, বসতি, পাহাড় কাটা, লগিং, পাথর উত্তোলন বন্ধ করা হলে গড়ে উঠবে নিবিড় বনভূমি৷ সেইসাথে মায়া হরিণ, গাউর, সম্বরের সংখ্যাবৃদ্ধি হলে বাঘ হয়তো স্থায়ীভাবেই ফিরে আসবে পার্বত্যাঞ্চলে। (সুন্দরবনের বাইরের বাঘ নিয়ে যার যা কিছু জানাশোনা, ধারণা কমেন্টে শেয়ার করতে পারেন।)

 

বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর সুন্দরতম প্রাণী৷ আরো গর্বের ব্যাপার যে এই বাঘের নামকরণ আমাদের নিজস্ব জনপদ বাংলার নামেই। প্রাকৃতিক বনভূমিতে বাঘের অস্তিত্ব একটি দেশের মর্যাদা বাড়িয়ে তুলে বহুগুনে। পৃথিবীতে মাত্র ১০ টি দেশে বাঘ টিকে আছে। আমরা সেই গর্বিত ১০ টি দেশের অন্যতম। আমার আশাবাদ সুন্দরবনের বাইরেও বাঘ একেবারে হারিয়ে যায়নি। তারা আছে হয়তো এবং যদি সত্যিই তা হয় তবে ব্যাপারটা দারুন হবে। এখন অপেক্ষা শুধু প্রামাণ্য দলিলের। 

 

বাঘকে আমরা নিজেদের সিম্বল বানিয়েছি তবে কেন বাঘের প্রতি এত অবহেলা? জানি সবাই আছে যার যার ধান্দায় তবু ফান্ডখোর এনজিও, গতিহীন আমলাতন্ত্র আর নীতিহীন রাজনীতিবিদদের অসুন্দর হৃদয়ের বিষাক্ত প্রঃশ্বাস এড়িয়ে এই সুন্দরতম প্রাণ অনন্তকাল সগৌরবে টিকে থাকুক এই ভূখন্ডে৷ আমাদের বাংলায়। বিশ্ব বাঘ দিবস সফল হোক।

Love
2
البحث
الأقسام
إقرأ المزيد
أخرى
Japan's Al Powered Drones are planting Forests 10 times faster Using Smart See Fod Technology Helping Restore Ecosystem From the air
Japan is transforming reforestation with AI-powered drones that can plant trees up to 10 times...
بواسطة Sharif Uddin 2025-08-04 04:56:35 0 369
Tech
পৃথিবীতে এমন এক ধাতু আছে, যা হাতে নিলেই গলে যায়!
ভাবতে পারো? একটা ধাতু, দেখতে একেবারে সিলভার বা পারার মতো চকচকে। তবে যদি তুমি সেটা হাতে নাও......
بواسطة Yeara Meherish 2025-08-02 20:11:17 0 247
Tech
মাথায় গুলির আঘাতে দুর্ঘটনাবশত একজনের মানসিক রোগ সেরে যায়
“জর্জ” নামে পরিচিত ১৯ বছর বয়সী এক যুবক ভয়ানক ওসিডিতে (OCD) ভুগছিলেন। তিনি দিনে শত...
بواسطة Sharif Uddin 2025-07-27 11:25:38 0 313
أخرى
হারিয়ে যাওয়া এক বিখ্যাত পেশা- ভিস্তিওয়ালা।
ইতিহাসে ভিস্তিওয়ালারা সুপরিচিত হয়ে আছে মুঘল সম্রাটের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন সেই সময় থেকে। ...
بواسطة Yeara Meherish 2025-07-31 18:07:16 0 255
أخرى
BRAC University’s Centre for Climate Change and Environmental Research (C3ER), University of Dundee এবং Resilience Solutions-এর যৌথ প্রচেষ্টায়। এর টেকসইতা ও দুর্যোগ-সহনশীলতার জন্য এটি ২০১৯ সালে জাতিসংঘের “UN Risk Award” অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু সংকটপ্রবণ দেশে যেখানে একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা সেই বাস্তবতায়...
بواسطة Sharif Uddin 2025-08-02 18:28:57 0 320
BlackBird Ai
https://bbai.shop