সামাদ তার অনন্য ফুটবল নৈপুণ্য দ্বারা গঙ্গার জলে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।’

0
148

ইউটিউব ঘাটলে রোনালদিনহোর একটা ভিডিও ক্লিপ পাওয়ার কথা। 

সেই ক্লিপে দেখা যায়, রোনালদিনহো নাইকির বুট পড়ে বলকে শট মেরে গোলবারে লাগাচ্ছেন। 

 

বল বারে লেগে ফেরত আসার পর সেটা মাটিতে পড়তে না দিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় আবার বারে মারছেন। 

ইউটিউবের প্রথম মিলিয়ন বার দেখা ক্লিপ এটা। 

দেখলে আসলে আশ্চর্যই লাগে, কীভাবে একজন মানুষ এই কাজটা এত সুচারুভাবে করতে পারেন। 

বলটা যেন তার কথা শোনে। 

এই কারণেই রোনালদিনহোকে ‘ম্যাজিশিয়ান’ বা জাদুকর বলা হতো।

প্রায় এমনই একটা ঘটনা ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।

খেলাটা হচ্ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভায়, ইন্দোনেশিয়া একাদশ আর ভারতীয় একাদশের মধ্যে। 

তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচে খেলছে দুই দলেরই তুখোড় সব খেলোয়াড়। 

চেষ্টা চালালেও কোনো পক্ষই গোল করতে পারছে না। 

ঠিক সেই সময় ভারতীয় দলের একজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের কয়েকজনকে সুন্দরভাবে কাটিয়ে শট করলেন গোলপোস্টে। 

কিন্তু বল বারে লেগে পোস্টের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলো।

এই ধরণের ঘটনা ফুটবল মাঠে বিরল কিছু নয়। 

তবে সেই খেলোয়াড়টি অবাক হয়ে পোস্টের কাছে গেলেন। 

 

যেন এমন কিছু হতে পারে, সেটা তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। 

 

এত সুন্দর করে বানিয়ে এনে এত মাপা শট বারের বাইরে যায় কিভাবে?  

তার মনে হলো, কিছু একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। 

গোলপোস্টের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রেফারিকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতে থাকলেন,

 

‘আপনি খেলা থামান, গোলপোস্টের উচ্চতা কম আছে। খেলা থামান, আমি চ্যালেঞ্জ করছি।’

 

রেফারিসহ বাকিরা অবাক হলেও অবাক হলেন না ভারতীয় দলের অন্যান্য সদস্যরা। 

 

কারণ, চ্যালেঞ্জ জানানো খেলোয়াড়টার প্রতি তাদের ধারণা ছিল। 

 

সবার দাবিতে রেফারি খেলা থামিয়ে ফিতা আনতে বাধ্য হলেন। 

 

পরে মেপে দেখলেন, আসলেই পোস্টের উচ্চতা দেড় ইঞ্চি কম। 

 

বাতিল করা গোলটা তখন গোল বলে গণ্য হলো।

 

নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী এই লোকটার নাম সামাদ। ভালোবেসে মানুষ তাকে ‘জাদুকর সামাদ’ নামে ডাকতো।

তার সম্পর্কে আরো অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। 

তিনি নাকি খেলতে নেমে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতেন, আর বাদাম খেতেন।  

ও হ্যাঁ, গোঁফে তা দেওয়াটাও ছিল সামাদের একটা স্বভাব। 

দলের অবস্থা যখন খারাপ হয়ে যেত, অথবা খেলার সময় যখন প্রায় শেষ সময়, তখন সঙ্গী খেলোয়াড় আর দর্শকদের চিৎকারে মাঠে নেমে ২/৩ টা গোল করে আবার ফিরে যেতেন আগের কাজে। 

 

গোল করা যেন তার কাছে ছিল ইচ্ছের বিষয়। 

জীবনে বহু ম্যাচের আগে নাকি খেলা শুরুর আগেই বলে দিয়েছেন কয়টা গোল করবেন, এবং দিনশেষে সেটাই করে ফেলেছেন।

সাধে কি তাকে আর জাদুকর ডাকা হতো?

 

ভারতীয় দলের হয়ে কিছু ম্যাচ খেলেছেন সামাদ। 

 

১৯২৪ সালে তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন। 

 

জাতীয় দলের হয়ে তিনি বার্মা, সিলন, হংকং, চীন, জাভা, সুমাত্রা, মালয়, সিঙ্গাপুর এবং ব্রিটেনে ভ্রমণ করেছেন। 

 

চীনের বিপক্ষে একবার একটা ম্যাচে তিনি খেলতে নামেননি ইনজুরির জন্য। 

 

প্রথম অর্ধেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে যায় তার দল। 

 

ক্ষিপ্রগতির চাইনিজ খেলোয়াড়দের বিপক্ষে কিছুই করতে পারছিলেন না ভারতীয় ডিফেন্ডাররা। 

 

কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধে সামাদ আর সহ্য করতে পারলেন না, কোচকে অনুরোধ করেন মাঠে নামাতে। 

কিন্তু ইনজুরড খেলোয়াড়কে মাঠে নামানোর ঝুঁকি নিতে কোচ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। 

 

সামাদ প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি ১৫ মিনিটের মাঝেই ৪টি গোল করবেন। 

 

সামাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে কোচ তাকে মাঠে নামান।  

 

মাঠে নামার তিন মিনিটের মাঝেই দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম গোলটি করে ফেললেন। 

পাঁচ মিনিট পরই তিনি মধ্যমাঠ থেকে শট করে সরাসরি আবারও গোল করে ফেললেন। 

সেই মুহূর্তে প্রকৃত বিপদটা আঁচ করতে পারলো চীনের খেলোয়াড়রা।

তারা সামাদের বিপক্ষে শক্ত ডিফেন্স করতে থাকলো। 

 

কিন্তু ‘সুপারম্যান’ সামাদ অল্প সময়ের মাঝেই আরো দুটি গোল করে দলকে ৪-৩ গোলের একটা অবিস্মরণীয় জয় উপহার দেন।

সেই সময়ে প্রতিবছরই কলকাতায় ভারতীয় একাদশ আর ইংল্যান্ড দলের মাঝে একটা ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো। 

 

সেই সময়ের ইংল্যান্ড দল পুরো বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে বেড়াতো। 

 

তাদের সাথে খেলতে পারাটাই ভারতীয় দলের জন্য সৌভাগ্য বলে বিবেচিত হতো। 

 

কিন্তু ১৯২৫ সালে সামাদের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দলকেও ৪-১ গোলে হারিয়ে দেয় ভারতীয় দল। 

কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সেই খেলার রিপোর্ট সম্পর্কে বলা হয়েছিলো,

‘সামাদ তার অনন্য ফুটবল নৈপুণ্য দ্বারা গঙ্গার জলে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।’

গঙ্গার জলে আগুন জ্বালানোটা যেমন অবিশ্বাস্য, ঠিক তেমনি সেই ম্যাচটাতে সামাদের পারফরম্যান্সও ছিল অবিশ্বাস্য।

 

জাদুকর সৈয়দ আবদুস সামাদের জন্ম হয়েছিলো ১৮৯৫ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ায়।

 

সামাদ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি নিয়ে পার্বতীপুরে চলে আসেন। 

 

যদিও রেলওয়ের কোনো প্লাটফর্মে ইন্সপেক্টর পদ ছিল না, তবুও সামাদের সম্মানার্থে এই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। 

 

দীর্ঘ ১০ বছর এখানেই চাকরি করে গিয়েছেন সামাদ। 

 

স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন রেলওয়ে কলোনিতে সামাদের জন্য বরাদ্দকৃত একটা ছোট বাংলো বাড়িতে। 

 

১৯৫১ সালে ঢাকার মাঠেও একটা প্রদর্শনী ম্যাচে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। 

 

প্রবীণ খেলোয়াড়দের প্রদর্শনী ম্যাচে ৫৬ বছর বয়স্ক সামাদ অংশ না করলেও জার্সি পড়ে মাঠে ঘুরে দর্শকদের আনন্দ দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে এই পার্বতীপুরের বাসাতেই সামাদ অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন। 

১৯৬৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ৬৯ বছর বয়সে সামাদ ইন্তেকাল করেন।

Rechercher
Catégories
Lire la suite
Autre
চাওয়া পাওয়া 🔥
ছেলের বিয়ে হয়ে গেলে ছেলে আর নিজের থাকেনা, বৌয়ের হয়ে যায়, কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও মেয়ে কোনোদিন...
Par Zihadur Rahman 2025-07-08 16:06:24 0 656
Tech
🌍 The Story of Google's Beginning: From Garage Startup to Global Giant
🧠 The Idea: Back in Stanford (1995–1996) In 1995, Larry Page, a 22-year-old computer...
Par Phoenix (Striker) 2025-07-07 06:08:03 3 721
Autre
রোবোটিক মাছটি তৈরি করা হয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ সারে, ইউকে তে।
প্রাকৃতিক রোবোটিক্স প্রতিযোগিতার অধীনে এটি 2022 সালে তৈরি করা হয়েছিল। এই প্রতিযোগিতায় সাধারণ...
Par Sharif Uddin 2025-08-11 06:27:41 0 289
Food
🍁☘️ব্লু টি (Blue tea recipe)🍁☘️
🍁☘️ব্লু টি (Blue tea recipe)🍁☘️   👇   উপকরণ • 2 সারভিংস • 2 টেবল চামচ...
Par Sharif Uddin 2025-07-26 15:26:15 0 209
Tech
ভালো মা হতে গিয়ে ক্লান্ত এক মা… আমি কি একটু থামতে পারি না?”
“একজন মা যখন শিশুর জন্য রাতভর জেগে থাকে, সকালে ক্লান্ত শরীর নিয়েও রান্নাঘরে দাঁড়ায়, দুপুরে...
Par Mehrish yeara 2025-07-31 19:29:00 2 219
BlackBird Ai
https://bbai.shop