পলাশীর কান্না—এক জাতির আত্মপরিত্যাগের পদচিহ্ন

0
276

ইতিহাস নয়, এক অব্যক্ত বিলাপের দলি

একটি সূর্য অস্ত গিয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের দুপুরে।

কিন্তু সে অস্তমান সূর্য রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল।

তা শুধু পলাশীর আম্রকাননে নয়, অস্ত গিয়েছিল গোটা এক জাতির সম্ভাবনার, সম্মানের, সাহসের ভবিষ্যৎ।

 

কখনো ভেবে দেখেছেন—নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের দিন কি সত্যিই কোনো বিজয় ঘটেছিল? না কি ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছিল এক জাতির আত্মত্যাগ, না, আত্মত্যাগ নয়—আত্মপরিত্যাগ?

---

সেদিন পলাশীর ময়দানে যখন এক কিশোর নবাব—যার চোখে জ্বলছিল অসম সাহস আর বুকের মধ্যে ধকধক করছিল হাজার বছরের বীরত্বের দাবী—যুদ্ধে নেমেছিল শত্রুকে প্রতিহত করতে, তখন তার পিছনে ছিল প্রায় ৪০ হাজার সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী। অশ্বারোহী, পদাতিক, কামান, বারুদ—সবই ছিল।

অথচ সামনে দাঁড়ানো শত্রুপক্ষ—মাত্র তিন হাজার।

তাদেরও অধিকাংশ ছিল অবসরপ্রাপ্ত, অপটু, অনভিজ্ঞ অফিসার, যাদের তলোয়ার কখনো রক্ত চেনেনি।

 

তবু সিরাজ হারলেন।

হারলেন কীভাবে?

তলোয়ারে না, সাহসে না, অভিজ্ঞতায়ও না—

হারলেন বিশ্বাসঘাতে,

হারলেন তাঁর জাতির অন্তর্গত পচনে।

---

রবার্ট ক্লাইভ তখন তার চোখের ভিতর দিয়ে দেখে ফেলেছিলেন গোটা একটা জাতিকে।

তাঁর ডায়েরিতে লেখা ছিল—

 

> "যদি সেই দিন হাজারো দর্শক, যারা নবাবের পেছনে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল,

যদি তারা শুধু একটি করে ঢিলও ছুঁড়তো,

তাহলে আমাদের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী।"

 

কিন্তু সেই ঢিল কেউ ছুঁড়েনি।

 

বরং যখন এক রাজাকে—যার বয়স মাত্র উনিশ, যে সবে জীবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়েছে—তাকে কাঁটাওয়ালা সিংহাসনে বসিয়ে, ছেঁড়া জুতা দিয়ে পেটানো হচ্ছিল, তাকে প্রকাশ্যে অপমানিত করা হচ্ছিল, তখন হাজারো চোখ কেবল হা করে চেয়ে ছিল—যেন এটা কোনো মেলার দৃশ্য, যেন এটা বিনোদনের বস্তু!

---

এমনকি যখন নবাবকে পিঠে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়, তখনও কেউ কিছু বলে না।

কেউ কিছুই করেনি।

কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করেছে এক বাঙালি রাজার ধ্বংস।

সেই চুপ করে থাকা মানে ছিল—গোলামির প্রতি মৌন সম্মতি।

সেই নীরবতা ছিল আত্মসমর্পণের প্রথম ঘোষণাপত্র।

---

রবার্ট ক্লাইভ তাই বুঝেছিলেন, এই জাতিকে জয় করতে বহু সৈন্য লাগে না।

এই জাতিকে দমন করতে কামান লাগে না।

এখানে বিশ্বাসঘাতক নিজেই অস্ত্র।

 

মীরজাফর তখন এক নগণ্য ব্যক্তি।

তাঁকে ‘নবাব’ হবার লোভ দেখানোই ছিল যথেষ্ট।

তিনি রাজি হয়ে যান।

তিনি শুধুই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি—

তিনি ছিলেন বাঙালির ভেতরের মৃত্যুঘণ্টার প্রথম বাজনাধারী।

 

সাথে ছিলেন উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ঘষেটি বেগম—

যারা প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থ আর হীনমন্যতার বিনিময়ে বিকিয়ে দেন এক তরুণ নবাব, এক দুরন্ত স্বপ্ন, আর এক স্বাধীন জাতির ভবিষ্যৎ।

 

আর রবার্ট ক্লাইভ?

তিনি হাসেন।

হাসেন এই ভেবে যে—

 

> “যে জাতি নিজের রক্ত বিক্রি করতে পারে,

তাদের শিরে স্বাধীনতার মুকুট সাজানো এক দুর্বোধ্য রসিকতা।”

---

পলাশী শুধু যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না,

তা ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ময়দান,

যেখানে তারা একসঙ্গে নিজের ইতিহাস, মর্যাদা, গর্ব, এবং সাহসকে সমাহিত করে আসে।

সেই কবরের উপরই গড়ে ওঠে দুইশো বছরের ইংরেজ শাসন।

যা শুরু হয়েছিল ঢিল না ছোঁড়া এক নীরব সম্মতিতে।

---

অথচ সিরাজ ছিলেন একটি প্রতীকের নাম।

একটি বিদ্রোহী তরুণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি,

যে চাইতো বিদেশি বেনিয়াদের শোষণ থেকে রক্ষা করতে তার মাতৃভূমিকে।

 

তার চোখে ছিল আগুন, তার হৃদয়ে ছিল প্রতিজ্ঞা।

কিন্তু তার চারপাশে ছিল বিশ্বাসঘাতকদের ফাঁদ।

আর মাঠের চারদিক জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল একদল দর্শক,

যারা আজও রয়ে গেছে আমাদের রক্তে—

দর্শক হয়ে, প্রশ্ন না করে, প্রতিবাদ না করে, প্রতিবাদীদেরও প্রশ্ন করে।

---

আর তাই আজও, যখন কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়,

তখন তার পিছনে হাততালি দেয়ার লোক কম থাকে,

চেয়ে চেয়ে দেখার লোক থাকে হাজার হাজার।

 

এই ইতিহাস বদলায় না,

শুধু পোশাক বদলায়, নাম বদলায়,

কিন্তু ‘দর্শক’ হয়ে থাকাটা জাতিগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

---

তবুও, কেউ যদি এই ইতিহাস পড়ে

একফোঁটা অশ্রু ফেলেন,

একটু লজ্জিত হন,

তবে হয়তো সিরাজের আত্মা আকাশের ওপারে কোথাও একটু হেসে উঠবে—

এই ভেবে যে, তার মৃত্যু বৃথা যায়নি।

---

শেষ কথা: সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় কেবল এক রাজনীতিক বা এক তরুণ নবাবের পতন নয়,

এটি এক মানসিকতার পরাজয়,

এক জাতির হৃদয়হীন আত্মসমর্পণের দুঃখগাথা।

 

আমরা যদি সেই আত্মসমর্পণকে চিহ্নিত না করি,

তবে প্রতিবারই নতুন রবার্ট ক্লাইভ আসবে,

আর আমরা দর্শক হয়েই বসে থাকবো—

ঠিক যেমন ছিল পলাশীর সেই হাহাকারের দিনে।

---

📚 যদি এই লেখা তোমার হৃদয়ে কোনো ঢেউ তোলে, শেয়ার করো।

পেজটি ফলো করো— Knowledge-জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার 

যাতে ইতিহাস আর না ঘুমায়,

আমরাও না ঘুমিয়ে থাকি।🕯️🇧🇩

Search
Categories
Read More
Tech
পৃথিবীতে এমন এক ধাতু আছে, যা হাতে নিলেই গলে যায়!
ভাবতে পারো? একটা ধাতু, দেখতে একেবারে সিলভার বা পারার মতো চকচকে। তবে যদি তুমি সেটা হাতে নাও......
By Yeara Meherish 2025-08-02 20:11:17 0 247
Other
🤖 কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব: এআই ও এর যুগান্তকারী অগ্রগতি
ভূমিকা: এআই কী? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) বা সংক্ষেপে এআই হলো এমন প্রযুক্তি...
By Phoenix (Striker) 2025-07-06 07:23:20 0 1K
Health
❕ ঘুম ও রাসায়নিক ভারসাম্য: এক রহস্যময় সংযোগ 🧠🌙
ঘুম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, কিন্তু জানলে অবাক হবেন – এটি নিয়ন্ত্রিত হয়...
By Yeara Meherish 2025-08-02 20:20:02 0 244
Ai
কেন চ্যাট জিপিটি সবার কাছে এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে
চ্যাটজিপিটি হল একটি অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ভিত্তিক চ্যাটবট। সহজ...
By Nurul Hasan 2025-07-17 20:43:30 0 528
Games
প্রায় চার দশক (৩৭ বছর) পর এ কীর্তি গড়লেন বাংলাদেশের মাহফিজুর রহমান সাগর ও নাজমুল হক হিমেল।
বাংলাদেশের কোনো সাঁতারু সবশেষ ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন ১৯৮৭ সালে, ১৯৮৭ সালে এ মাইলফলক...
By Sharif Uddin 2025-07-31 17:58:25 0 278
BlackBird Ai
https://bbai.shop